আভিধানিক অর্থ : الطهارة والنماء والبركة والمدح অর্থাৎ পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ও প্রশংসা। উল্লিখিত সব কয়টি অর্থই কুরআন ও হাদীছে উদ্ধৃত হয়েছে।
পারিভাষিক অর্থ : ইসলামী শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত নিছাব পরিমাণ মালের নির্দিষ্ট অংশ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করার নাম যাকাত।[1]
কুরআন ও হাদীছের অনেক স্থানে ‘যাকাত’-কে ‘ছাদাক্বাহ্’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। কুরআন মাজীদের ৮ টি মাক্কী ও ২২টি মাদানী সূরার ৩০টি আয়াতে ‘যাকাত’ শব্দটি উল্লিখিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি আয়াতে ‘ছালাত’-এর সাথেই ‘যাকাত’ শব্দ এসেছে।
যাকাত ইসলামী অর্থনীতির প্রধান উৎস : ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। যার মধ্যে নিহিত আছে মানব জীবনের যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান। আর অর্থনৈতিক সমস্যা মানব জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশে দু’টি প্রধান অর্থনৈতিক মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। পুঁজিবাদ বা ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রি অর্থব্যবস্থা। এ্যাডম স্মীথের হাত ধরে যে পুঁজিবাদের যাত্রা তাতে শুধুই ব্যক্তিস্বার্থ ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতার গন্ধ। ব্যক্তির ভোগ ও তৃপ্তি চূড়ান্ত হতে হবে, সর্বোচ্চ পরিমাণ তৃপ্তি বা উপযোগ লাভের সর্বাত্নক চেষ্টা পুঁজিবাদের মূল দর্শন। সমাজের হতদরিদ্র বা বঞ্চিতদের জন্য ছাড় দেওয়ার কোন সুযোগ সেখানে নেই। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাও এর কোন সমাধান বের করতে পারেনি। আদর্শিকভাবে এই দুই বিপরীত মেরুর বিরুদ্ধেই ইসলামের অবস্থান। সুতরাং ইসলামী অর্থনীতি উল্লিখিত দুই অর্থনীতির আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মকৌশলের দিক থেকে ভিন্ন। যেমন-
(ক) ইসলামী অর্থনীতির মূল উৎস হল কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। অপরদিকে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা মানব রচিত। এ্যাডম স্মিথ, রিকার্ডো, মার্শাল, কার্লমার্কস, লেলিন প্রমুখ অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক এসব অর্থব্যবস্থার প্রবক্তা।
(খ) পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সম্পদের ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে সম্পদের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা স্বীকৃত। অপরদিকে ইসলামী অর্থনীতিতে পৃথিবীর সকল সম্পদের মালিক হলেন মহান আল্লাহ। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নির্দেশিত পথে এ সকল সম্পদ মানুষ ভোগ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
(গ) পুঁজিবাদে উৎপাদনকারীর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে। পক্ষান্তরে ইসলামী অর্থনীতি আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি চলে মুনাফা অনুযায়ী, তাতে জনগণের ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। আবার সমাজতন্ত্রে উৎপাদন চলে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী; এতে জনগণের ভোগের স্বাধীনতা থাকে না। অপরদিকে ইসলামী অর্থনীতিতে উৎপাদন পদ্ধতিতে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের কল্যাণের দিকে নযর রাখা হয়।
(ঘ) পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আর্থনীতিতে অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে হারাম ও হালাল যাচাই করা হয় না। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধ দ্বারা হালাল ও হারাম বিবেচনা করা হয়।
(ঙ) পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে সম্পদের মূল ভিত্তি হল সূদ। অন্যদিকে ইসলামী অর্থনীতিতে সূদ সম্পূর্ণরূপে হারাম।
অতএব ইসলামী অর্থনীতির মধ্যেই মানব জাতির অর্থনৈতিক সকল সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে। আর ইসলামী অর্থনীতির প্রধান উৎস হল, যাকাত ব্যবস্থা। সামাজিক সাম্য অর্জনের অন্যতম মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসাবেই যাকাত বিবেচিত হয়ে থাকে। সমাজে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বিরাজমান ব্যাপক পার্থক্য হরাসের জন্য যাকাত অত্যন্ত উপযোগী হাতিয়ার। যাকাত কোন স্বেচ্ছামূলক দান নয়; বরং দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত ও বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর লোকদের জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বাধ্যতামূলকভাবে প্রদেয় অর্থ। সামাজিক নিরাপত্তা অর্জন বিশেষতঃ দুস্থ ও অভাবগ্রস্তদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যই যাকাতের ক্ষেত্রে এত কঠোর তাকীদ রয়েছে।