তিনি ছিলেন সত্যানুসন্ধ্যানী। পুরনো কুসংস্কারকে মুচড়ে ফেলে শৃঙ্খলতার বাইরে এসেও নিজের সংস্কার থেকে পিছপা হননি। সর্বদা তার দর্শনে নতুন রূপ প্রকাশের সন্ধান করে গিয়েছেন। যার জন্য কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা গণ্ডির বাইরে যেতেও ভয় পেতেন না তিনি। বলছিলাম সমসাময়িক প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারের কথা। নিরীক্ষাধর্মীতার জন্য বিখ্যাত এ শিল্পী গত ১৮ অক্টোবর নিজের ইস্কাটনের বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাথরুমে পড়ে গিয়ে পরলোকে পাড়ি জমান।
শিল্পী হিসেবে সর্বোচ্চ দক্ষতার প্রমাণ দেয়া কালিদাস রঙ ও রূপের এক পরিপূর্ণতা দেখিয়েছেন। যার সবগুলো ছিল দর্শনীয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো- তিনি যা দেখাতে চেয়েছেন তার রূপ দিতে সফল হয়েছেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসস্পন্ন কালিদাস কেবল ব্যাতিক্রমধর্মী উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্যই বিখ্যাত নন, বরং তিনি এমন কিছু কাজ করে গেছেন যা সমাজে তার সমসাময়িক অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলেও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্মের পরে যে সমাজটি একইসঙ্গে গৌরবময় ও দুরন্ত হয়ে উঠছিল, সেই প্রশ্নে সমাজটি এখনও প্রবাহিত অবস্থায় রয়েছে। ১৯৭৬ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে কালিদাসের চিত্রকর্মের প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। একটি শিল্পী পরিবারে (নামের সঙ্গে কর্মকার) জন্ম নেয়া কালিদাসের রক্তেই যেন রয়েছে শিল্প সত্ত্বা। তার বাবাসহ পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য আাঁকাআাঁকির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যদিও তাদের ফরিদপুরের বাড়ির পরিবেশ পরিস্থিতিতে তা প্রকাশের সুযোগ ছিলো না।
শিল্পী হওয়ার আগে উদ্ভিদবিদ্যার ওপর প্রবল আকর্ষণ ছিলে কালিদাসের। কারণ তার পরিবারের অগ্রজ সদস্যরা কবিরাজিও করতেন। যারা বিভিন্ন গাছ-গাছালির শিকর-বাকরের ওপর নির্ভরশীল থাকতেন। কালিদাস মেধাবীও ছিলেন। ক্লাসের এ সেরা ছাত্রটি এমন একটি গ্রুপের সাথে মেলামেশা করতেন যারা সমাজের সমস্যা সৃষ্টিকারীদের মারধর করেও বেরাতেন (কালিদাস নিজেই বলেছেন)।
তিনি অষ্টম এবং নবম শ্রেণি মিস করেছেন। তার পরে তিনি তাঁর স্কুল শিক্ষকদের, বিশেষত সংস্কৃত, গণিত ও ইংরেজি শিক্ষকদের – ভালোভাবে পাস করিয়ে দেয়ার ভয়ও দেখিয়েছিলেন। আর এসব কিছুর জন্য তিনি ‘পাগলা’ বলে পরিচিত ছিলেন।
ঢাকা কুরিয়ারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কালিদাস বলেন, ‘কর্মকার পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণে হয়তো শিল্প বিষয়টি আমার জিনে ছিল। আমি নিজে নিজে চর্চা করেছি এবং ১৯৬০ দশকে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছি। কাকতালীয়ভাবে আমি যেদিন ঢাকা আসি, সেদিনই ভর্তি পরীক্ষা ছিল। আমার মনে আছে আর্ট কলেজের নতুন শিক্ষক হাশেম খান আমাকে একটি সাদা কাগজ ও কলম দিয়ে এক ঘণ্টায় একটি গাছ এঁকে দেখাতে বলেছিলেন। আমি মাত্র ১০ মিনিটে এঁকে দেখিয়েছিলাম, যা তাকে মুগ্ধ করেছিল। আমার সমস্ত শৈল্পিক জ্ঞানের জন্য আমি শিল্পী হাশেম খান ও মোস্তফা মনোয়ারকে ক্রেডিট দিতে চাই।’
পরবর্তীতে তিনি ১৯৬৯ সালে কলকাতার কলেজ অব ফাইন আর্টস ও ক্রাফটস থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন। পরে তিনি ওয়ারশোতে পোলিশ সরকারের (পোল্যান্ড তখনও আয়রন কার্টেনের অধীনে ছিল এবং স্নায়ুযুদ্ধ তখনো শেষ হয়নি) একটি কর্মসূচি ‘উচ্চতর কর্মশালায়’ যোগ দেন, যেখানে তিনি অধ্যাপক রাফায়েল স্ট্রেন্ট এবং আলেকসান্দার কোবজাদেজের অধীনে ক্লাসিকাল প্রিন্টমেকিং শিখেছিলেন। যেটি পরে তিনি তার হৃদয়ে ধারণ করেছেন।
ঢাকায় ফিরে কালিদাস দেশে প্রথমবারের মতো প্রিন্টিমেকিং কর্মশালার আয়োজন করেন। যেখানে নতুন এ টেকনিকটি শিখতে আগ্রহী বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী অংশ নিয়েছিলেন। প্রায় একই সময়ে, তিনি তাদের একসঙ্গে রেখেছিলেন যা বাংলাদেশের প্রথম গ্রাফিক আর্ট প্রদর্শনী হিসাবে পরিণতি লাভ করে।
পরে তিনি আবারও অভিনব কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন। গ্রাফিক্স শিল্পের ব্যাপারে প্রয়াত বিখ্যাত স্থপতি শামসুল ওয়ারেসের কাছে যা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। আমাদের সময়ে অসাধারণ মনের অধিকারী শামসুল ওয়াসের সঙ্গে বিখ্যাত হন কালিদাস।
প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় পরে প্রিন্ট মেকিংয়ের ওপর তার গভীর ভালোবাসার প্রবণতায় গ্যালারি কসমসের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সেখানে দেশে প্রথমবারের মতো অত্যাধুনিক প্রিন্টমেকিং মেশিন স্থাপন করেন। গ্যালারি কসমসের আলাদা ইউনিট স্থাপনকৃত এলাকাটি পরে ‘আতেলিয়ার-৭১’ প্রিন্টিমেকিং স্টুডিওতে পরিণত হয়।
যাই হোক, আমাদের কাজ শুরুর পরেই বা ১২১টি আইটেমের মধ্যে মাত্র একটি প্রদর্শণীর পরই কালিদাস শিল্পকলা পদকে ভূষিত হন এবং তার এক বছর পরেই একুশে পদকে ভূষিত হন, যার মাধ্যমে তা শিল্পসত্ত্বা দেশে চূড়ান্তভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীতে ঢাকা কুরিয়ারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন কালিদাস।
নিজের আত্মপ্রকাশের থেকে সেই গল্পটিতে ফিরে আসার পরে তিনি প্রদর্শনীর জন্য বেশ কয়েকটি চিত্রকর্ম তৈরি করেন যেগুলোকে আমরা মেটাল বা ধাতব কোলাজ বলে থাকি। তারমধ্যে এমন একটি চিত্রকর্ম ছিল যেখানে একটি সূর্যমুখী ফুলের মধ্যে বুলেটের আঘাতের মতো ছিল। এ চিত্রকর্মের মাধ্যমে কালিদাস অনন্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। এটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, উপস্থাপনের দৃঢ়তা এতটাই দারুণ ছিল যে প্রতিটি ব্যক্তি যেকোনো ব্যাখ্যাতে পৌঁছাতে পারতো আবার পারতো না। তবে কালিদাসের মতে, তৎকালীন দৈনিক বাংলায় কাজ করা প্রয়াত খ্যাতনামা কবি শামসুর রহমান ছাড়া কেউ এর অর্থ বুঝতে সক্ষম হয়নি। যেটি ছিল আগের বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার শৈল্পিক প্রতিবাদ।
এতোক্ষণে আপনাদের অভিনবত্ব এবং শৈল্পিক সমতল সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া হয়েছে, যার ওপরে সেই প্রদর্শনী দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এক সপ্তাহ পেছানোর পরেও ২১ দিনের দীর্ঘ প্রদর্শনী বাতিল করতে হয়েছিল। কালি দা (যে নামে আমরা তাঁকে ডাকি) আমাদের কাছে গর্ব ছিলেন। কালিদাস এমন কেউ ছিলেন না যে, যাকে সহজেই ভুলে যাওয়া যায়, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্প ইতিহাসে শ্রদ্ধার আসনে থাকবেন তিনি।
কেবল কোনো প্রযুক্তিগত দক্ষতা বা উচ্চতর দক্ষতার জন্যই নয় (নিশ্চিত যা তিনি করেছিলেন), বরং তার দৈর্ঘ্যের চেয়ে আরও বেশি প্রয়োজনীয় কিছুর জন্য তাকে মনে রাখা যায়। কয়েক বছর ধরে অগণিত একক প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে কালিদাস তাঁর ভক্তদের দরজায় অনবরত নিষেধাজ্ঞাগুলো ঝুলিয়ে দেওয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ জানাতেন। কালিদাস তার কর্মে শিল্প সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন যেমন এটি কী হতে পারে, এর সম্ভাবনাগুলো এবং এর সম্ভাব্য উপাদানগুলো নিয়ে।
তার জীবন-ধারণের বিষয়বস্তু, মৌলিক চিহ্ন সমূহ, টটেমিক বা তান্ত্রিক প্রতীক, পাওয়া বস্তু (কড়ি, নুড়ি) ও তার ব্যবহার তার সময়ে নজিরবিহীন ছিল। শুধু তাই নয়, এখনো অদ্বিতীয় তিনি। তাঁর কাজের প্রভাব এবং প্রভাবের নিদর্শন হিসাবে কালিদাস মোটিভ বা তাদের প্রতিধ্বনিগুলো আজকের ফ্যাশন ডিজাইনে তাদের পথ খুঁজে পেয়েছিল।
কয়েক বছর ধরে, কালিদাস তাঁর প্রিন্টমেকিং এবং গ্রাফিক আর্ট থেকে শুরু করে ইনস্টলেশন এবং নতুন / মিশ্র মিডিয়াতে প্রথমবারের মতো পুরো ঘরানা এবং প্রবর্তন করে তাদের শ্রোতাদের এবং সহশিল্পীদের তাদের দিগন্তকে প্রসারিত করার জন্য চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তার তারকাখ্যাতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পূর্বে জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে তিনি গত কয়েক বছর ধরে বেশিরবাগ সময়গুলো দুই মেয়ের সাথে কাটাচ্ছিলেন।
মৃত্যুর আগে তিনি মাত্রই ফিলিপাইনের একটি চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে ঢাকা পৌঁছেছিলেন। ম্যানিলার ন্যাশনাল কমিশন ফর কালচার অ্যান্ড দ্যা আর্টস (এনসিসিএ) গ্যালারেতে ‘ফ্রম ম্যানিলা টু ঢাকা, ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি: অ্যান আর্ট এক্সপোজিশন’ শীর্ষক গ্রুপ কর্মশালাটিই তার জীবনের শেষ কর্মশালা হয়ে থাকলো।।
প্রায় ৪৩ বছর আগে রাতের আকাশে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব হয়েছিল তার। যার পরে বাংলাদেশে তেমন কোনো আর্টের দেখা পাওয়া যায়নি। স্বাধীনাতার মাত্র পাঁচ বছরই পার হয়নি বাংলাদেশের, তার মধ্যে যে রক্তপাতের ঘটনা ঘটল, যাকে এ লিগ্যাসি অব ব্লাড (রক্তের ঋণ) বলে বর্ণা করা যায়। এবং ১৯৭৬ সালে ওই সময় জাতি হিসেব তখনো দারিদ্র, ক্ষুধা এবং পূর্ববর্তী বছরের ঘটনা যেমনটি দেখিয়েছিল, এখনও রাষ্ট্র তার কার্যক্ষমতার অর্থাৎ হিংসাত্মক বিভ্রান্তির ঝুঁকির মধ্যে ছিল, এখনও তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়নি।
এমন সময়ে গর্ত থেকে হঠাৎ থেকে হঠাৎ করেই এমন একজন শিল্পীর উত্থান ঘটেছিল, যিনি স্পষ্টতই কোনো ট্র্যাজেডি বা শোকের গল্প খুঁজছিলেন না। বরং তার কাজটি পুরোপুরি, প্রকৃতিগতভাবে আধুনিক সংবেদনশীলতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, যা এখনো শিল্পীর নিজস্ব অনন্য ব্যক্তিত্ব দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, তাঁর গঠনমূলক অভিজ্ঞতা। কালিদাস ছিলেন পাললিক শিলার মতো। যিনি প্রকৃতিগতভাবে বেড়ে উঠেছিলেন যেমন করে মাটির স্তর জমে জমে জমি তৈরি হয়, হিমালয় থেকে তৈরি হওয়া নদী যেভাবে সাগরে পতিত হয়। কিন্তু আজ তিনি আবারও অজনায় চলে গেছেন। তবে কোনো উত্তরাধিকার সুরক্ষার জন্য নয়, যারা তাঁকে চিনতেন, তারা নিজেরাই তাঁকে মনে রাখবেন।