বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক হিসাব পরিচিতি ও খোলার নিয়ম

বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক হিসাব পরিচিতি ও খোলার নিয়ম

বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক হিসাব পরিচিতি ও খোলার নিয়ম:

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে যে, ব্যাংকসমূহ পুঁজি গঠনের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে আমানত সংগ্রহ করে। এজন্য ব্যাংক গ্রাহককে বিভিন্ন ধরণের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে হিসাব (Account) খোলার মাধ্যমে জনগণকে ব্যাংকে অর্থ জমা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকে। ব্যাংক হচ্ছে অর্থ বা মূল্যবান সম্পদ নিরাপদে গচ্ছিত রাখার এক উৎকৃষ্ট স্থান। হিসাব ব্যতীত ব্যাংকে অর্থ বা সম্পদ জমা করা যায় না। তবে হিসাব না খুলেও সীমিত কিছু ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণ করা যায়। হিসাব খোলার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের প্রকৃত গ্রাহকে পরিণত হন। তাই ব্যাংকিংয়ের পূর্ণ উপযোগ গ্রহণ করতে হলে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকে অবশ্যই কোন না কোন হিসাব খুলতে হবে।

ব্যাংক হিসাব (Bank Account) :
ব্যাংক হিসাব হল গ্রাহকের পক্ষে ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত এমন একটি হিসাব যেখানে আমানতকারী অর্থ জমা করতে পারে আবার প্রয়োজনে যেকোন সময় জমানো অর্থ উত্তোলনও করতে পারে। হিসাব খোলার মাধ্যমে ব্যাংক এবং গ্রাহকের মধ্যে মূলত: একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। Contact Act-1872 এর অধীনে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। হিসাব খোলার মাধ্যমে ব্যাংক এবং গ্রাহকের মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরি হয়। হিসাব খোলার মাধ্যমে গ্রাহকের একদিকে যেমন সঞ্চয়ের মানসিকতা তৈরি হয়, অপরদিকে সঞ্চিত অর্থের নিরাপত্তা, আমানতের বিপরীতে সুদ প্রাপ্তি, ঋণ সুবিধাসহ গ্রাহক জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখার সুযোগ পান।

কারা ব্যাংকে হিসাব (Account) খুলতে পারেন
১. সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন বৈধ পরিচয়পত্রধারী যেকোন নাগরিক ব্যাংকে হিসাব খুলতে পারেন।

২. আইনগত অভিভাবক নিযুক্ত করে বৈধ পরিচয়পত্রধারী কোন নাবালক হিসাব খুলতে পারেন।

৩. অন্ধ, শারীরিক প্রতিবন্ধী, নিরক্ষর ব্যক্তি বৈধ পরিচয়পত্র থাকলে হিসাব খুলতে পারেন।

৪. একক বা যৌথ মালিকানাধীন বৈধ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা হিসাব খুলতে পারে।

৫. তবে চুক্তি করতে অসমর্থ, মানসিক বিকারগ্রস্ত, আদালত-ঘোষিত দেউলিয়া ব্যক্তি ব্যাংকে হিসাব খুলতে পারেন না।

ব্যাংকে হিসাব খোলার জন্য সাধারণ (Common) কিছু ডকুমেন্টস:
পরিচয়দানকারী (Introducer): ব্যাংকে যেকোনো ধরণের হিসাব খোলার জন্য পরিচয়দানকারী বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট শাখায় কমপক্ষে ছয় (০৬) মাস আগে থেকে হিসাব নিয়মিতভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে এবং ইতোমধ্যে একজন বিশ্বস্ত গ্রাহকে পরিণত হয়েছেন এমন একজন গ্রাহক, যিনি আবেদনকারীকে ভালোভাবে চেনেন এবং জানেন, এই শর্তে ব্যাংকে সশরীরে উপস্থিত হয়ে আবেদন ফরমে হিসাব নম্বর ও শিরোনাম উল্লেখপূর্বক স্বাক্ষর প্রদান করবেন। আবেদনকৃত গ্রাহক যদি অসৎ, অবৈধ ব্যবসায়ী, চোরাচালানী, মদ্য ব্যবসায়ী, অপহরণকারী বা মানি লন্ডারিংয়ের সাথে যুক্ত থাকেন বা ছিলেন সেক্ষেত্রে তার পরিচয় প্রদান করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকা উচিৎ। একই ব্যাংকের অন্য শাখার গ্রাহকও পরিচয়দানকারী হতে পারেন। সেক্ষেত্রে উক্ত শাখার ব্যবস্থাপক কর্তৃক পরিচয়দানকারীর স্বাক্ষর সত্যায়িত করে নিতে হবে। Dormant/In-Operative হিসাবের গ্রাহক পরিচয় প্রদান করতে পারবেন না। তবে হিসাবটি সচল করে নিয়ে পরিচয় প্রদান করা যাবে। হিসাবধারী গ্রাহক ছাড়াও এলাকার কোন গণ্যমান্য ব্যক্তিও পরিচয়দানকারী হতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচয়দানকারী হওয়ার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক

জাতীয় পরিচয়পত্র/স্মার্ট কার্ড/পাসপোর্ট/ড্রাইভিং লাইসেন্স/জন্ম সনদ :

আঠারো (১৮) বা তদুর্দ্ধ বয়সের কোনো ব্যক্তির হিসাব খোলার ক্ষেত্রে গ্রাহক এবং নমিনি উভয়ের বৈধ জাতীয় পরিচয়পত্র বা বিকল্প হিসেবে উপরোল্লিখিত পরিচয়পত্রের যে কোন একটির ফটোকপি সরবরাহ করতে হবে এবং মূল কপি প্রদর্শন করতে হবে। পরিচয়পত্রে উল্লিখিত ঠিকানার সাথে যদি স্থায়ী ঠিকানার গরমিল হয় সেক্ষেত্রে স্থায়ী ঠিকানার প্রমাণপত্রস্বরূপ বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, ওয়াসা বিল, টেলিফোন বিলের কপি ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে। জন্মসনদ দিয়ে হিসাব খোলা হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাতীয় পরিচয়পত্র উত্তোলন করে ব্যাংকে সরবরাহ করতে হবে।

সম্প্রতি তোলা পাসপোর্ট আকারের রঙিন ছবি: গ্রাহক এবং নমিনি উভয়ের দুই (০২) থেকে তিন (০৩) কপি করে সম্প্রতি তোলা পাসপোর্ট আকারের রঙিন ছবি দিতে হবে। গ্রাহকের ছবি পরিচয়দানকারী কর্তৃক এবং নমিনির ছবি গ্রাহক কর্তৃক সত্যায়ন করতে হবে। ছবি এমন হতে হবে, যেন ছবি দেখে ব্যক্তিকে খুব সহজেই শনাক্ত করা যায়। মূখমন্ডল বাঁকা করে/হাসিমুখে/মুখমন্ডল উঁচু-নিচু করে/ মুখমন্ডলে কাপড় জড়িয়ে তোলা ছবি গ্রহণযোগ্য নয়। দাঁড়ি-গোফ বিহীন ছবি প্রদানের পর দাড়ি-গোঁফ রাখলে বা চুল ছোট-বড় করলে পুণরায় ছবি তুলে সরবরাহ করতে হবে।

Tax Identification Number (TIN): যদি কারো TIN সনদ থাকে তবে তা ব্যাংকে সরবরাহ করলে গ্রাহক উৎসে-কর (Source Tax) তথা প্রাপ্ত সুদের উপর আরোপিত সরকারি কর কর্তনে ছাড় পাবেন (১৫% এর স্থলে ১০% কর্তন করা হবে)।

ফোন নম্বর বা e-mail: আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর ব্যাংকিংয়ে ফোন নম্বর বা ই-মেইল এড্রেস খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ব্যাংক বা গ্রাহক উভয়েরই যেকোনো জরুরী প্রয়োজনে উভয়ের সাথে যোগাযোগ করার জন্য মোবাইল নম্বর বা মেইল এড্রেস সরবরাহ করা ভাল। গ্রাহকের প্রদত্ত ফোন নম্বরে হিসাবসংক্রান্ত যেকোন তথ্য যেমন- হিসাবের ব্যালেন্স, লেনদেনের পরিমাণ ইত্যাদি এসএমএস এর মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়। সেজন্য সঠিক ফোন নম্বর এবং মেইল এড্রেস সরবরাহ করতে হবে।

নমিনি মনোনয়ন : ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১’ (২০১৩ পর্যন্ত সংশোধিত)-র ১০৩ ধারার উপধারা ০১ অনুযায়ী কোন হিসাবধারী গ্রাহক এক বা একাধিক ব্যক্তিকে নমিনি নিযুক্ত করতে পারবেন। হিসাবধারী ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় উক্ত মনোনয়ন বাতিল করে ব্যবস্থাপক বরাবর লিখিত আবেদনপূর্বক অন্য কোন ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গকে নমিনি হিসেবে মনোনীত করতে পারবেন। নমিনি/নমিনিগণের ব্যাংকে সশরীরে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক নয়, তবে গ্রাহক চাইলে নমিনি উপস্থিত থেকে আবেদন ফরমে স্বাক্ষর করতে পারেন। উপধারা ০২ অনুযায়ী নমিনি নাবালক হলে নাবালকের অর্থ কে গ্রহণ করবে তা হিসাবধারী নির্দিষ্ট করে দিতে পারবেন। নমিনি নিযুক্তিকরণের জন্য মনোনীত ব্যক্তির প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে হবে। কোন হিসাবে নমিনি মনোনীত করা না থাকলে গ্রাহকের মৃত্যুর পর আদালত কর্তৃক ঘোষিত উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে প্রাপ্য অর্থ অংশ অনুযায়ী বন্টিত হবে।

প্রাথমিক জমা ব্যাংকে কোন হিসাব খোলার পরপরই উক্ত হিসাবে ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রাথমিকভাবে জমা দিতে হয়। সঞ্চয়ী হিসাবে সাধারনত ব্যাংক ভেদে ৫০০-১০০০ টাকা, কৃষক হিসাবে ১০ টাকা, শিক্ষার্থী সঞ্চয়ী হিসাবে ১০০ টাকা, পথশিশু হতদরিদ্র সঞ্চয়ী হিসাবে ১০ টাকা, চলতি ও এসএনডি হিসাবে ১০০০-২০০০ টাকা পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে জমা দিতে হয় যা উত্তোলনযোগ্য নয়। প্রতি ছয় (০৬) মাস পরপর (জুন ও ডিসেম্বরে) ন্যূনতম স্থিতি হতে সার্ভিস চার্জ ও অন্যান্য চার্জ কর্তন করা হয়।

প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব খোলার জন্য উক্ত তথ্যসমূহের পাশাপাশি অতিরিক্ত

যেসব তথ্য সরবরাহ করতে হবে

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে

১. ম্যানেজিং কমিটির রেজুলেশন।

ক্লাব বা সোসাইটির ক্ষেত্রে

১. কনস্টিটিউশন/বাই লজ।

২. অনুমোদিত ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গের দ্বারা হিসাব খোলা ও পরিচালনা সংক্রান্ত কর্তৃপক্ষের গৃহীত সিদ্ধান্তের অনুলিপি।

৩. অফিস বেয়ারাদের তালিকা।

পৌরসভার ক্ষেত্রে

১. যে আইন বা বিধান দ্বারা প্রতিষ্ঠান সংগঠিত হয়েছে তার অনুলিপি।

ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে

১. ট্রাস্ট দলিল।

২. ট্রাস্টি বোর্ডের রেজুলেশন।

৩. সকল ট্রাস্টির স্বাক্ষর।

লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে 

১. সার্টিফিকেট অব কমেন্সমেন্ট অব বিজনেস (পাবলিক লি: কোঃ)।

২. ট্রেড লাইসেন্স ও TIN Certificate.

৩. কোম্পানির আর্থিক বিবরণী।

৪. সার্টিফিকেট অব ইনকর্পোরেশন।

৫. কোম্পানির প্যাডে চেয়ারম্যান কর্তৃক স্বাক্ষরিত পরিচালকদের নামের তালিকা।

৬. হিসাব খোলা ও পরিচালনা সংক্রান্ত ‘রেজুলেশন অব দি বোর্ড অব ডাইরেক্টর’।

৭. হিসাব খোলা ও পরিচালনার জন্য সহ-অংশীদারের অনুমতি।

৮. হিসাব পরিচালনাকারীদের ছবি, নামের তালিকা, নিয়োগপত্র ও নমুনা স্বাক্ষর।

৯. কোম্পানির মেমোরেন্ডাম ও আর্টিকেল অব এসোসিয়েশনের সার্টিফাইড কপি।

১০. আরজেএসসি ফরম ১২ কপি (রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিস এ্যন্ড ফার্মস কর্তৃক ইস্যুকৃত কোম্পানির পরিচালকদের নাম ও ঠিকানার নিশ্চয়তাপত্র)।

অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে

১. ট্রেড লাইসেন্স ও TIN Certificate.

২. অংশীদারি চুক্তিপত্র।

৩. অংশীদারি দলিলের কপি।

৪. নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তের কপি।

৫. অংশীদারদের ঠিকানাসহ নামের তালিকা।

৬. পরিচালক ও অংশীদারদের নামের তালিকা।

৭. হিসাব খোলা ও পরিচালনা সংক্রান্ত পরিচালক ও অংশীদারদের অনুমতিপত্র।

৮. প্রকৃত ব্যবসা ও অংশীদারিত্বের প্রমাণ হিসেবে সর্বশেষ পরিচালনা ও অডিট রিপোর্ট।

বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক, বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক

About Post Author

Related posts