অনুপাত বিশ্লেষণের সীমাবদ্ধতা কী কী?

অনুপাত বিশ্লেষণের সীমাবদ্ধতা কী কী? (What are the limitations of ratio analysis? )

একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সচ্ছলতা ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতা ও মুনাফা অর্জন ক্ষমতা যাচাই করার ক্ষেত্রে অনুপাত বিশ্লেষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল ও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তবে অনুপাতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী মুল্যায়ন, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যাকরণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
অনুপাত বিশ্লেষণের সীমাবদ্ধতা বা অসুবিধাসমূহ নিম্নরূপ :

১. আদর্শ অনুপাত নির্ণয়ে জটিলতা: অনুপাত বিশ্লেষণের সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নির্ণীত অনুপাতের সাথে আদর্শ অনুপাতের তুলনা করা হয়।
প্রকৃত অর্থে, আদর্শ অনুপাত কোনটি তা নির্ধারণ করা খুবই কঠিন।
কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের ইচ্ছামতো আদর্শ অনুপাত নির্ধারণ করে নেয়।
আর ঐ ইচ্ছামতো নির্ধারণ করা আদর্শ অনুপাতের সাথে প্রতিষ্ঠানের নির্ণীত অনুপাতের তুলনা ও বিশ্লেষণ কখনোই যথার্থ হয় না।

২. স্বল্পকালীন নির্ণীত ত্রুটিপূর্ণ অনুপাত: সুদীর্ঘকালের জন্য অনুপাত বিশ্লেষণ না করে নির্দিষ্ট কোনো স্বল্পকালের জন্য নির্ণীত অনুপাত একদিকে যেমন ত্রুটিমুক্ত হয় না; অন্যদিকে তা তথ্যবহুলও হয় না। ফলে এ ধরনের অনুপাত বিশ্লেষণ দ্বারা প্রতিষ্ঠানের কোনো উপকার হয় না।

৩. সঠিক পথ-নির্ণীত ত্রুটিপূর্ণ অনুপাত: যেসব তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিষ্ঠানের অনুপাত নির্ণয় করা হয়, সেগুলো সঠিক না হলে অনুপাত নির্ণয় সঠিক হয় না। অনেক সময় অনুপাত বিশ্লেষণের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা হিসাবে কারচুপির মাধ্যমে ব্যবসায়ের প্রকৃত অবস্থা গোপন করে ভালো অবস্থা দেখিয়ে থাকে। এসব লোক দেখানো অনুপাত বিশ্লেষণ দ্বারা সঠিক পথ-নির্দেশনা পাওয়া যায় না।

৪. তুলনামূলক বিশ্লেষণে অপারগতা: সঠিক অনুপাত বিশ্লেষণ নিশ্চিত করার জন্য আন্তঃপ্রতিষ্ঠানের তুলনামূলক অনুপাত বিশ্লেষণের আবশ্যকতা রয়েছে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় তা করা সম্ভব হয় না। কারণ একেক প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষণ একেক রকম।

৫. অতীত ঘটনা নির্ভর অনুপাত: সাধারণ একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অতীত ঘটনা বিশ্লেষণ করে অনুপাত নির্ণয় করা হয়। এসব অতীত ঘটনা নির্ভর অনুপাত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তেমন কার্যকর হয় না।

অনুপাত বিশ্লেষণের সীমাবদ্ধতা কী কী

৬. গুণভিত্তিক ফলাফল নির্দেশে ব্যর্থতা: প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গুণভিত্তিক ফলাফল অধিক গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু অনুপাত বিশ্লেষণ গুণভিত্তিক ফলাফল নির্দেশ করতে পারে না। কারণ এটি সাধারণত সংখ্যাত্মক ফলাফল নির্দেশ করে।

৭. অনুপাত বিশ্লেষণ আর্থিক বিষয়ের চূড়ান্ত ধাপ নয় : অনুপাত বিশ্লেষণ একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ত্রুটিপূর্ণ কার্যক্রমসমূহ চিহ্নিত করলে সেগুলো সংশোধনের ব্যবস্থা করে না। ফলে অনুপাত বিশ্লেষণকে আর্থিক বিশ্লেষণের চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে গণ্য করা যায় না।

৮. মূল্যস্তর পরিবর্তনের সাথে সমন্বয়: একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণীসমূহ বিশেষ করে উদ্বর্তপত্রের বিভিন্ন সম্পত্তির যে মূল্য প্রদর্শন করা হয় সেগুলোকে মূল্যস্তর পরিবর্তনের সাথে সমন্বয় সাধন করা হয় না। ফলে অনুপাত বিশ্লেষণ কোনো তুলনাযোগ্য ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

৯. বর্ণিত দফা সম্পর্কে মতপার্থক্য: একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণীতে প্রদর্শিত বিভিন্ন দফা; যেমন- চলতি সম্পত্তির দফা, চলতি দায়ের দফা, প্রতিষ্ঠানের নীট সম্পত্তি, বিনিয়োজিত মূলধন সম্পর্কে বিভিন্ন আর্থিক বিশ্লেষক বিভিন্ন মত পোষণ করেন। ফলে অনুপাত নির্ণয় ও বিশ্লেষণে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়।

অনুপাত বিশ্লেষণের সীমাবদ্ধতা কী কী

১০. অন্যান্য কৌশলের সাথে সম্পর্কিত: নগদ প্রবাহ, তহবিল প্রবাহসহ অন্যান্য কৌশলের সাথে অনুপাত বিশ্লেষণ সম্পর্কিত। ফলে অনুপাত নির্ণয় ও বিশ্লেষণ প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়।

১১. সীমিত সংখ্যক অনুপাত নির্ভর : অনেক সময় সীমিত সংখ্যক অনুপাতের ভিত্তিতে অনুপাত বিশ্লেষণ করা হয়। ফলে এ ধরনের অনুপাত বিশ্লেষণের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বিভ্রান্তকর হয়ে পড়ে। তাছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানগত কলাকৌশলের সাহায্য গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা সম্ভব হয় না।

১২. সাজানো প্রতিবেদন: অনেক প্রতিষ্ঠানের অনুপাত বিশ্লেষণ হলো লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সাজানো প্রতিবেদন মাত্র। হিসাবের কারচুপির মাধ্যমে কারবারের প্রকৃত অবস্থার চাইতে উন্নত অবস্থা প্রদর্শন করা হয়। সুতরাং এরূপ তথ্যের ভিত্তিতে নির্ণীত অনুপাতগুলো কখনো নির্ভরযোগ্য।

১৩. যথাযথ ব্যাখ্যার অভাব: অনুপাত বিশ্লেষণের অন্যতম অসুবিধা হলো যথাযথভাবে ব্যাখ্যার অভাব রয়েছে। অনুপাত বিশ্লেষণের জন্য যথাযথ আর্থিক বিবরণী ও এগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সকল প্রতিষ্ঠানের অনুপাত বিশ্লেষণের যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া না।

১৪. আন্তঃপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় সমস্যা: বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে এবং একই প্রতিষ্ঠানের একধিক বছরের মধ্যে কার্যকরভাবে তুলনা করতে হলে সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তথ্যগুলো একই নিয়মে সংগৃহীত হওয়া প্রয়োজন।

পরিশেষে উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণের জন্য অনুপাত বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করতে হয়। উল্লেখিত সীমাবদ্ধতার কারণে অনুপাত বিশ্লেষণ অনেক সময় অসার প্রমাণিত হয়।

About Post Author

Related posts