অর্থের কার্যাবলি আলোচনা করুন।

অর্থের কার্যাবলি আলোচনা করুন। Discuss the functions of money.

উত্তর: আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থ হলো একটা অপরিহার্য উপাদান।
দ্রব্য বিনিময় প্রথার অসুবিধাগুলো দূর করার লক্ষ্যে অর্থের উদ্ভব হলেও বর্তমানকালে অর্থ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে।
অর্থের প্রধান কার্যাবলি নিচে আলোচনা করা হলো :

১। বিনিময়ের মাধ্যম (Medium of Exchange): অর্থের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা।
অর্থ প্রচলেনের পূর্বে সমাজে দ্রব্য বিনিময় প্রথা প্রচলিত ছিল। কিন্তু এ প্রথার প্রধান অসুবিধা ছিল এই যে, ক্রেতা ও বিক্রেতার অভাবের মধ্যে সামঞ্জস্য না ঘটলে বিনিময় সম্ভবপর হতো না।
এ অসুবিধা দূর করবার জন্য অর্থের ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে লোকে সরাসরি পণ্যের সাথে পণ্য বিনিময় না করে অর্থের সাথে পণ্যের বিনিময় করে। পরে সেই অর্থের বিনিময়ে সে তার প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় করে। এভাবে অর্থ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে অথ্য দ্রব্য বিনিময় প্রথার জটিলতা দূর করেছে এবং বিনিময় ব্যবস্থা সহজ ও সরল হয়েছে।
অধ্যাপক R. H. Marshall এবং R. B. Swanson যথার্থই বলেন, “Money in its function as a medium of payment is the life blood of the modern exchange economy.”

২। মূল্যের পরিমাপক (A Measure of Value): অর্থ বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য পরিমাপক হিসেবে কাজ করে। দ্রব্য প্রথায় মূল্য পরিমাপের কোনো সাধারণ মানদন্ড না থাকায় বিভিন্ন প্রব্যের আপেক্ষিক মূল্য নির্ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন ছিল।
কিন্তু সব প্রব্যের মূল্য পরিমাপের সাধারণ মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হিসাবের একক বা মূল্যের পরিমাপক হিসেবে অর্থের সবচেয়ে বড় অবদান হলো যে দ্রব্য বিনিময় ব্যবহার পরিমাপজনিত অসুবিধা দূরীভূত হয়েছে।
অর্থের মাধ্যে বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ যেমন সম্ভব হয়েছে তেমনি বিভিন্ন ধরনের লেনদেনের হিসাব রাখাও সহজ হয়েছে। মূলোর পরিমাপক হিসেবে অর্থ নিঃসন্দেহে বিনিময় ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ সম্ভব করে তুলেছে।

৩। সঞ্চয়েরা বাহন (A Store of Value): অর্থ সঞ্চয়ের বাহন হিসেবে কাজ করে। মানুষ তার আয়ের সময়টাই বর্তমান ভোগের জন্য বায় করে না। সে এর কিছু অংশ ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেয়।
কিন্তু তা দ্রব্যের মাধ্যমে সঞ্চয় করা সম্ভব নয়। কারণ, অধিকাংশ দ্রব্যই ক্ষণস্থায়ী ও পচনশীল। কিন্তু এ সব দ্রব্য বিক্রয় করে যদি তার বিক্রীত মূল্য অর্থের মাধ্যমে সঞ্চয় করা হয় তা হলে তা নষ্ট হওয়ার কোন ভয় থাকে না।
এজন্য মানুষ উদ্বৃত্ত দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয় করে তার মূল্য অর্থের মাধ্যমে ধরে রাখে। এভাবে অর্থ সঞ্চয়ের বাহন বা মূল্যের সংরক্ষক হিসেবে কাজ করে। মূল্যের সংরক্ষক বা সঞ্চয়ের ডাণ্ডার হিসেবে অর্থও বর্তমান ও ভষ্যিতের মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপন করে।
অর্থনীতিবিদ কেইন্‌স যথার্থই মন্তব করেছেন, “The importance of money essentially flows from its being a link between the present and the future.”

৪। স্থগিত লেনদেনের মান ( A Standard of Deferred Payments): অর্থ মানুষের ভবিষ্যৎ দেনা-পাওনা মিটানোর বা স্থগিত লেনদেনের মান নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। আধুনিক সমাজে আর্থিক লেনদেনের বেশির ভাগই ধারে চলে। এ সব দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশ অর্থের মাধ্যমে করা হয়। কারণ, দ্রব্যের মূল্য সহজেই পরিবর্তিত হয়। দ্রব্যের মাধ্যমে দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশ করা হলে ঋণদাতা বা ঋণ গ্রহীতাকে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু অর্থের মূল্য সহজে পরিবর্তিত হয় না বলে মানুষ অর্থের মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশ করে থাকে। এজন্য অর্থ স্থগিত লেনদেনের মান হিসেবে কাজ করে।

৫। মূল্য স্থানান্তরের বাহন (Means of Transferring Value): অর্থ প্রচলনের ফলে মানুষ তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি স্থানান্তর করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষ কোন দ্রব্যসামগ্রী বা সম্পত্তি একস্থানে বিক্রয় করে তার মূল্য অর্থের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারে এবং ঐ অর্থ মূল্য দ্বারা সে অন্যত্র দ্রব্যসামগ্রী বা সম্পত্তি ক্রয় করতে পারে। এভাবে অর্থ দ্রব্য বা সম্পত্তির মূল্য স্থানান্তরের বাহন হিসেবে কাজ করে।

৬। ঋণের ভিত্তি (Base of Credit): অর্থ ঋণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রকার ঋণপত্র লেনদেন পরিশোধের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যেমন- চেক, ব্যাংক ড্রাফট, হুন্ডি ইত্যাদি। আমানত হিসেবে রক্ষিত নগদ অর্থের ভিত্তিতেই ব্যাংক এসব ঋণপত্র প্রচলন করে থাকে। সুতরাং অর্থই হলো সব প্রকার ঋণের ভিত্তি।

৭। তৃপ্তি বৃদ্ধি করার উপায় (Means of Maximising Satisfaction): অর্থ মানুষকে বিভিন্ন দ্রব্য হতে সর্বাধিক তৃপ্তি পেতে সহায়তা করে। মানুষ যখন তার নির্দিষ্ট আয় দ্বারা বিভিন্ন দ্রব্য ক্রয় করে তখন সে তা হতে সর্বাধিক তৃপ্তি পেতে চেষ্টা করে। বিভিন্ন দ্রব্য হতে প্রাপ্ত প্রান্তিক উপযোগ যখন পরস্পর সমান হয় তখনই ক্রেতা বা ভোক্তার তৃপ্তি সর্বাধিক হয়। কিন্তু অর্থ ছাড়া বিভিন্ন দ্রব্য হতে প্রাপ্ত প্রান্তিক উপযোগের মধ্যে তুলনা করা যায় না।
একমাত্র অর্থের সাহায্যে বিভিন্ন ক্রীত দ্রব্যের প্রান্তিক উপযোগ ও দামের সমতা আনয়ন করে ক্রেতা বা ভোগকারী সর্বোচ্চ তৃপ্তি পেতে সক্ষম হয়। এভাবে অর্থ মানুষের তৃপ্তি বৃদ্ধি করার উপায় হিসেবে কাজ করে।

৮। তারল্যের মান (Standard of Liquidity): অর্থ তারল্যের মান হিসেবে কাজ করে। আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ অর্থের তারল্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অর্থ হলো সর্বাপেক্ষা তরল সম্পদ।
সাধারণভাবে সকলেই অর্থ গ্রহণ করে এবং হস্তান্তর করে। অর্থের সাহায্যে যে-কোন দ্রব্য যে কোন সময় ক্রয় করা যায়। এজন্য অর্থকে সম্পদের ভরল আকার বলা হয়। এভাবে অর্থ তারল্যের মান হিসেবে কাজ করে।

সুতরাং আধুনিক জগতে অর্থ গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি পালন করে থাকে। অর্থ প্রচলনের ফলে লেনদেনের সব অসুবিধা দূর হয়েছে এবং বিনিময় ব্যবস্থা সহজ ও উন্নত হয়েছে।
অধ্যাপক মার্শাল যথার্থই বলেন অর্থকে কেন্দ্র করেই আধুনিক জগৎ আবর্তিত হচ্ছে।

About Post Author

Related posts